শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, যার রেজি নং-৩৬)

গাইবান্ধায় মুরগীর সিন্ডিকেট: এসএমএস-এ বাড়ে দাম

গাইবান্ধায় মুরগীর সিন্ডিকেট: এসএমএস-এ বাড়ে দাম
ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধাঃ গাইবান্ধার মুরগীর বাজারগুলোতে এক রকম হরিলুট কারবার চলছে। এতে ভোক্তার পকেট কেটে প্রতিদিন লুটে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। শহরের ব্যবসায়ীদের কাছে মুরগি কেনাবেচার নেই কোনও রশিদ। এমনকি, সরকারিভাবে প্রতিটি দোকানে পণ্যের মূল্যতালিকা টাঙানোর পাশাপাশি ক্রয়-বিক্রয়ের রশিদ সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও, বাজারের কোনও ব্যবসায়ী তা অনুসরণ করছেন না। কোম্পানিগুলো প্রতিদিন ডিলারদের দাম নির্ধারণ করে দিলেও চাহিদা বাড়লেই ডিলাররা সেই দামে না বেচে একটি ‘মুরগি সিন্ডিকেট’ এসএমএস-এ বাড়িয়ে দেয় দাম। গত এক মাসে ব্রয়লার মুরগির ‘সরবরাহ কম ও বেশি দামের’ মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে ভোক্তার সাথে রীতিমতো প্রতারণা করছে ‘মুরগি সিন্ডিকেট’ চক্রটি। বাজারগুলোতে ভোক্তা অধিকার বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে অর্থ জরিমানাসহ শেষবারের মত সতর্ক করলেও, টনক নড়ছে না ব্যবসায়ীদের।সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১০ থেকে ২০ মে রাত পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা ২০০ টাকা কেজির নিচে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেননি। বাজারে ব্রয়লার মুরগি ব্যবসায়ীদের ক্রয়ের খসড়া টালি খাতা (ক্রয় রশিদ/পাকা মেমো না থাকায়) দেখে জানা যায়, ১০ মে রাতে তারা প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি কিনেছেন ১৫৫ টাকা দরে। আবার একই তারিখে (১০ মে) পর পর দুবার প্রতিকেজি ব্রয়লার ১৬৩ টাকায় ক্রয় দেখানো হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে ভোক্তার কাছে বিক্রি হয়েছে  ২০০/২১০ টাকায়। ঠিক এক দিন পরেই (১১ মে) প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির ক্রয় দেখানো হয়েছে ১৮৭ টাকা। অর্থাৎ এক রাতের ব্যবধানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছিল ২৪ টাকা! পরের দিন (১২ মে) দাম অপরিবর্তিত থাকে ১৮৭ টাকায়। এই দাম অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা খুচরা বাজারে ভোক্তার কাছে বিক্রি করেন ২২০ টাকা। এরপর ১৩ মে সকাল থেকে ২০ মে রাত পর্যন্ত প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগির ক্রয় দেখানো হয়েছে ১৬৩ থেকে ১৭৫ টাকা পর্যন্ত। আর খুচরা বাজারে ভোক্তার কাছে প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করা হয় ২০০ টাকায়। ২১ মে রাত পর্যন্ত খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেছেন ২০০ টাকায়। আশ্চর্যের বিষয়, কেজিতে ১৫/২০ টাকা লাভ করার কথা থাকলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট কাটছেন ভালোভাবেই। অথচ করোনা পরবর্তী বিপর্যস্ত ভোক্তা জানছে পারছেন না, মুরগির কেজিপ্রতি সঠিক দাম কত? আর তিনি কিনছেন কত দামে।
জানতে চাইলে বাজারে মুরগি কিনতে আসা ক্রেতা স্মরণ ইসলাম  বলেন, ‘বাজারের কোনও দোকানেই মূল্যতালিকা ও ক্রয় রশিদ নেই। শুনলাম এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা। কিন্তু বাজারে এসে ২০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের নজর দেওয়া দরকার’।
কথা হয় আরেক ক্রেতা শাকির মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাজারে মুরগির দামের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। সকালে এক দাম, বিকেলেই আরেক। অনেক সময় মুরগির দাম শুনে বাজারে আসি। কিন্তু আসার পর যখন দেখি দাম বেশি। তখন আর শেষ পর্যন্ত মুরগিই কেনা হয় না’। পুরাতন বাজারের ব্যবসায়ী নাসির ও খুশু মিয়া। তাদের দোকানেও মুরগি কেনার কোনও রশিদ নেই। টাঙানো নেই দামের তালিকাও। এমনকি, সাধারণ হিসাবের টালিখাতাও নেই। জানতে চাইলে কর্মচারীরা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাল (মুরগি) কিনি রাতে। সকালে ক্রয় রশিদ দেওয়ার কথা থাকলেও, আমাদের তা দেওয়া হয় না। কেজিপ্রতি দাম মহাজনেরাই নির্ধারণ করে দেয়। হিসাবের খাতাও থাকে তাদের কাছে। আমরা শুধু সেই দামের চাইতে ১৫/২০ টাকা লাভ করি। তারা কত দামে কিনে আমাদের দেয়, সেটা জানি না’। শহরের মুরগি ব্যবসায়ী বিপ্লব জানান, ডিলারদের সাথে প্রান্তিক খামারিদের চুক্তি থাকে। সেই অনুযায়ী মুরগি বড় হলে ডিলাররা একটা দাম ধরে সেগুলো কিনে নেয়। ডিলাররা আবার বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সাথে যুক্ত থাকে। কোম্পানিগুলো প্রতিদিন মুঠোফোনে এসএমএস’র মাধ্যমে ডিলারদের কাছে দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু ডিলাররা সেই এসএমএস’র দামে আমাদের মুরগি দেয় না।
তিনি আরও বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন এসএমএস’র নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০/১২ টাকা কেজিতে বেশি ধরে ডিলাররা আমাদের কাছে বিক্রি করে। যেহেতু তাদের সাথে আমাদেরও বাকিতে ব্যবসা করতে হয়, তাই আমরাও চুপচাপ তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই কিনতে হয়’। সদর উপজেলার মাঠবাজার এলাকার ব্যবসায়ী ইছা মিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন মোবাইলে এসএমএস করে মুরগির দাম নির্ধারণ করে একটি কুচক্রি মহল। একেক দিন একেকটা দামে মুরগি কেনা লাগে। ফোন করলেই মাল দিয়ে যায়। তবে, মহাজনেরা মাল কেনার কোনও পাকা ফর্দি (ক্যাশ মেমো/ ক্রয় রশিদ) দেয় না। ওনারা যেদিন যেদাম কয়, সেই দামেই কেনা লাগে। এভাবেই দাম বাড়ে’।
এভাবেই ভোক্তাদের জিম্মি করে মুরগির বাজার থেকে প্রতিদিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জেলার কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত মুরগি সিন্ডিকেট। এই ব্যবসায়ীরাই আবার চুক্তি অনুযায়ী খামারিদের মুরগির বাচ্চা, খাবার, ওষুধ- সবকিছু বাকি দেন। সময় হলে উৎপাদিত মুরগি তারাই আবার বিক্রি করেন জেলার বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে। অর্থাৎ, খামারিদের কাছে বাচ্চা ও খাবার উচ্চমূল্যে বিক্রি করে একদফা মুনাফা করেন। আবার বিক্রির সময় আরেক দফা লাভ করে এই চক্রটি।
এ ছাড়া, ৮ থেকে ১০টি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনের এসএমএস-এ কেজিপ্রতি যে দাম নির্ধারণ করা হয়, সেই নির্ধারিত দামের চেয়ে ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি দাম ধরে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন এই ডিলার পর্যায়ের অসাধু চক্রটি। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়তি দাম দিয়ে মুরগি কিনতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। আর এই চক্রের ফাঁদে পড়ে সর্বনাশ হচ্ছেন সাধারণ মানুষের। অথচ প্রতিটি দোকানে প্রতিদিনের বিক্রয়মূল্য টাঙানো এবং ক্রয়-বিক্রয় রশিদ রাখতে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমরা বাজারের এসব অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টা করছি। ব্যবসায়ীদের বার বার বলার পরও মূল্যতালিকা টাঙানো এবং ক্রয় রশিদ সংরক্ষণে তাদের অনিহা লক্ষ্য করা গেছে। ভোক্তা অধিকারসহ আমরা বাজারে গেলে মূল ব্যবসায়ীদের পাওয়া যায় না। আমাদের সাথে তারা চোর-পুলিশ খেলে’।
গাইবান্ধা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার অন্যত্র বদলি হয়েছে। তারপরও নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে নিয়মিত অভিযানের ব্যবস্থা করা হবে’।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘বাজারে নিয়মিত অভিযানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে বার বার করে বলা হয়েছে।এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন